ডিজিটাল বাংলাদেশ দিবস-২০১৯
"সত্য-মিথ্যা যাচাই আগে, ইন্টারনেটে শেয়ার পরে"
নাসিরনগর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া।
আজ ১২ই ডিসেম্বর, ডিজিটাল বাংলাদেশ দিবস। ২০০৮ সালের ১২ই ডিসেম্বর, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর দলের নির্বাচনী ইশতেহারে ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণের ঘোষণা দেন। এ কারণেই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কে ডিজিটাল বাংলাদেশের রূপকার বলা হয়। তিনি ২০০৯ সালে ক্ষমতায় এসে ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণের কাজে হাত দেন এবং ২০১০ সালের ১১ নভেম্বর সারাদেশের সকল ইউনিয়নে ডিজিটাল সেন্টার একযোগে উদ্বোধন করে ডিজিটাল বাংলাদেশ নির্মাণের প্রথম পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। বর্তমানে এই ডিজিটাল সেন্টার গুলো থেকে প্রতি মাসে ৬০ লক্ষ জনগণ ১৫০ রকমের সেবা গ্রহণ করছে। এছাড়া ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণের জন্য সরকার ৫০% এর অধিক জনসংখ্যার জন্য ইন্টারনেট সুবিধা প্রদান, ইউনিয়ন পর্যায় পর্যন্ত উচ্চ গতির ব্রডব্যান্ড ও অপটিক্যাল ফাইবার কানেকশন প্রদান করা, স্কুল গুলোতে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম স্থাপন, ৮০০০ স্কুলে শেখ রাসেল ডিজিটাল ল্যাব স্থাপন, ৮ টি শেখ কামাল আইটি ট্রেনিং ইনকিউবেশন সেন্টার নির্মাণ, ২৮টি হাইটেক পার্ক নির্মাণের চলমান কাজ, বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইট মহাকাশে উৎক্ষেপণ, ইতোমধ্যে আইটি খাতে ১০ লক্ষ কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা এবং ২০২১ সালের মধ্যে আরও ১০ লক্ষ কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা সহ ইত্যাদি উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন। ডিজিটাল বাংলাদেশের গুরুত্ব ও তাৎপর্য অনুধাবন করে বর্তমান সরকার মন্ত্রিসভা বৈঠকে ১২ই ডিসেম্বরকে ডিজিটাল বাংলাদেশ দিবস হিসেবে পালনের অনুমোদন দেয়। এরই ধারাবাহিকতায় ২০১৭ সাল থেকে প্রতিবছর ১২ই ডিসেম্বর কে পালন করা হচ্ছে ডিজিটাল বাংলাদেশ দিবস।
আজ ১২ই ডিসেম্বর ২০১৯, ৩য় বারের মত সারাদেশে উদযাপিত হচ্ছে ডিজিটাল বাংলাদেশ দিবস। এবারের দিবসের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় "সত্য-মিথ্যা যাচাই আগে, ইন্টারনেটে শেয়ার পরে"। এই প্রতিপাদ্যের ভিতর মূলত ইন্টারনেটের সঠিক ব্যবহারের উপর আলোকপাত করা হয়েছে। এখন আমাদের জানা জরুরী ইন্টারনেট মূলত কি? আমার ভাষায়, ইন্টারনেট একটি শক্তিশালী মাধ্যম যার মাধ্যমে সমস্ত দুনিয়ার সাথে সংযুক্ত হওয়া যায়, সমস্ত মানুষের সাথে যোগাযোগ করা যায়, যার মাধ্যমে নিজের মনে সৃষ্ট যে কোন প্রশ্নের উত্তর এক নিমিষেই খুঁজে পাওয়া যায়, যার মাধ্যমে অজানা দুনিয়াকে জানা যায় ও দেখা যায়। মানব জাতির ইতিহাসে এই প্রথমবার আমাদের কাছে সামর্থ রয়েছে, আমরা কিছু একটা গোটা বিশ্বকে বলতে পারি এক চেষ্টাতে এবং আমাদের সামর্থ রয়েছে গ্রহের প্রত্যেকটি মানুষের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করার। ইন্টারনেট সৃষ্টি হওয়ার পূর্বে যা কল্পনারও বাইরে ছিল। ইন্টারনেট সৃষ্টি হওয়ার সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে এটাই যে, আমাদের সর্বোচ্চ সম্ভাবনা ও উদ্ভাবনী চিন্তা মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে পারি এক মুহূর্তেই। আমাদের সৃষ্টিশীল কর্ম ও প্রতিভা, আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি, চিন্তা, চেতনা ও বিশ্বাস সমস্ত দুনিয়ার মানুষের কাছে তুলে ধরতে পারি ইন্টারনেট ব্যবহারের মাধ্যমে। একই সাথে এই ইন্টারনেট ব্যবহার করেই মানুষ নেতিবাচক কর্ম, প্রতিহিংসা, সাম্প্রদায়িক ভেদাভেদ ও দাঙ্গা, ঈর্ষার মত বিষয় নিমিষেই ছড়িয়ে দিতে পারে সমস্ত মানুষের কাছে। যার পরিণতি হতে পারে ভয়াবহ। এখানেই ইন্টারনেট ব্যবহারের সব চেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। যদি কেউ তার নেতিবাচক কর্ম কিংবা উস্কানিমূলক বক্তব্য ছড়িয়ে দিতে সক্ষম হয়, তাহলে সমাজে বিশৃঙ্খলার সূত্রপাত হয় এবং দেশের মধ্যে অস্থিরতা ও অরাজগতা তৈরি হয়। আর আমাদের দেশে সাম্প্রতিক সময়ে এই ঘটনাগুলোর ভয়াবহভাবে পুনরাবৃত্তি ঘটায় এবারের ডিজিটাল বাংলাদেশ দিবসের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় – “সত্য মিথ্যা যাচাই আগে, ইন্টারনেটে শেয়ার পরে”।
আমরা যদি সাম্প্রতিক কালের কিছু ঘটনার দিকে আলোকপাত করি, যেমন-
১) কক্সবাজার জেলার রামুতে ২০১২ সালের ২৯শে সেপ্টেম্বর, ফেসবুকে ধর্ম নিয়ে কটূক্তিমূলক একটি ছবি ট্যাগ করার ঘটনা নিয়ে বৌদ্ধ পল্লিতে হামলার ঘটনা সংঘটিত হয় এবং সেই ঘটনায় ১৯ টি বৌদ্ধমন্দির ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলো
২) ২০১৩ সালে, ‘শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলামের সমর্থকদের উপর পুলিশের গুলিতে নিহতের সংখ্যা ২৫০০ জন’ এমন মিথ্যা সংবাদ বা ফেক নিউজ ফেসবুক-ইউটিউবে ভাইরাল করা হয়, যার ফলে দেশে অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি হয়।
৩) ২০১৮ সালে, নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলনকারীদের উপর পুলিশ ও ছাত্রলীগের নির্যাতন, খুন ও ধর্ষণের ভুয়া খবর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচার হয়, যার ফলে কমলমতি শিক্ষার্থীরা আতঙ্কিত হয়ে পড়ে ছিল।
৪) ২০১৯ সালেই, পদ্মা সেতু নির্মাণে শিশুদের কাটা-মাথার ব্যবহার গুঁজব, যা শিশু ও অভিভাবকদের আতঙ্কিত করেছিল ও ছেলে ধরা সন্দেহে এক শিশুর মাকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছিল।
৫) অতি সাম্প্রতিক ঘটে যাওয়া ভোলার বোরহানউদ্দিন উপজেলায় পুলিশের সাথে এলাকাবাসীর সংঘর্ষ যা ফেসবুকে একটি উস্কানিমূলক পোস্টকে কেন্দ্র করে সংঘটিত হয় এবং চার জন গ্রামবাসী নিহত হয় ও পুলিশ সদস্য আহত হয়।
৬) এবং আমাদের প্রিয় নাসিরনগরে ২০১৬ সালের ৩০শে অক্টোবর, কাবা ঘরের সঙ্গে হিন্দুদের দেবতা শিব এর একটি ছবি উদ্দেশ্য প্রণোদিত ভাবে ফেসবুকে শেয়ার করায় প্রায় তিনশো হিন্দু বাড়ি ভাংচুর করা হয় ও ৫ টি মন্দির ভাংচুরের ঘটনা ঘটে। আর এই ঘটনার জন্য শুধু দেশেই না, বিদেশী সংবাদ মাধ্যমে নাসিরনগরকে বিভিন্ন ভাবে সমলোচিত হতে হয়েছে।
এই ঘটনাগুলোর তদন্ত রিপোর্টে দেখা গিয়েছে প্রত্যেকটি ঘটনার সূত্রপাত ঘটেছে ‘ফেইক নিউজ’ তথা গুঁজব, কান-কথা বা উস্কানিমূলক কথার মাধ্যমে। এবং এই গুজবকে কিছু উৎসুক ও স্বার্থান্বেষী মানুষ ইন্টারনেট তথা ফেসবুকে ছড়িয়ে দিয়েছে দ্রুত গতিতে। তাই এই সকল ঘটনার যেন আর কোন পুনরাবৃত্তি না ঘটে তার জন্য আমাদের প্রত্যেককে সচেতন হতে হবে, প্রত্যেককে অন্যদের সচেতন করার দায়িত্ব গ্রহণ করতে হবে।
আমাদের যে রোগটা হয়েছে সেটা হচ্ছে- ধরুন, আমরা একটা আদর্শ বা নীতিতে বিশ্বাস করি, যদি এই আদর্শ বা নীতির বিপরীত কোন আদর্শ-নীতিতে বিশ্বাসী আরও একটি দল বা গোষ্ঠী গড়ে ওঠে, তাহলে আমরা আমাদের বিশ্বাসগুলো বাঁচাতে এবং সমাজে প্রতিষ্ঠিত করতে বিপরীত বিশ্বাসী মানুষগুলোকে চিরতরে ধ্বংস করে দিতে চাই। আমাদের এই ধ্বংসাত্বক মনোভাব থেকেই আমরা এতো বেশী অন্ধদের মত কাজ করি, যার প্রেক্ষিতে সমাজে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়। তাই আমাদের এই ধ্বংসাত্বক মনোভাবের পরিবর্তন করা অতি প্রয়োজন।
আমাদের পরিবারে ও স্কুল-কলেজ গুলোতে শিক্ষার্থীদের মূল্যবোধ ও নৈতিক শিক্ষার উপর গুরুত্ব দিতে হবে, ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলা এবং একই সাথে ভিন্ন মত, ধর্ম ও সংস্কৃতিকে সম্মান করার শিক্ষা দিতে হবে; পাশাপাশি ফেসবুক, ইউটিউব ও ইন্টারনেটের ব্যবহার সম্পর্কে সচেতন করতে হবে। পরিবার গুলোতে পড়ার টেবিলে, খাবার টেবিলে, পারিবারিক গল্পগুঁজবে ইন্টারনেট ও ফেসবুক ব্যবহারের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করতে হবে, সভা সেমিনার গুলোতে এ ব্যাপারে কথা বলতে হবে। তাহলেই হয়তো আমরা একটি সচেতন প্রজন্ম গড়ে তুলতে পারব, যে প্রজন্মের কাছে ইন্টারনেট কোন অভিশাপ নয়, বরং ইন্টারনেট মৌলিক অধিকার হিসেবে বিবেচিত হবে এবং ভবিষ্যৎ বিনির্মাণে সহায়ক ভুমিকা পালন করবে।
পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে: মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, এটুআই, বিসিসি, ডিওআইসিটি ও বেসিস